Friday, April 3, 2015

সিঁড়ি ভেঙ্গে পথ দেখানো নারী - আদন ইসলাম (CHE-CD) - dailyjanakantha

সিঁড়ি ভেঙ্গে পথ দেখানো নারী

তারিখ: ২৬/১২/২০১৪
‘পরিচ্ছন্নতা কর্মী’ দলিত, সুইপার যে নামেই ডাকি না কেন এ নামগুলোর সঙ্গে কতগুলো শব্দ প্রসঙ্গতই সামনে এসে যায় সেগুলো হলোÑ অস্পৃশ্য, অশুচি, ঘৃণ্য। পরিচ্ছন্নতার কাজ ব্যতিরেকে তথাকথিত ভদ্র সমাজের মানুষের অন্য কোন কার্যক্রমে এদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। নগরে থেকেও নেই নাগরিক সুযোগ-সুবিধা; শতবর্ষ ধরে কাজ করেও আজ হয়নি ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ অথবা ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক’ কর্মীর স্বীকৃতি। ‘শ্রম আইন-২০০৬’ এখানে খাটে না, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০০০-এর ‘সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা’ সেøাগান এদের জন্য অর্থহীন বললেই চলে।
এরকম একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবকার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ধরিত্রী ফাউন্ডেশন ফর ইনফরমেশন এডুকেশন’ এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে যে মানুষটি রয়েছেন তিনি একজন নারী। ‘আদন ইসলাম’ নামে দাফতরিক কর্মজগতে তাঁর পরিচিতি কিন্তু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি ‘মৌ আপা’ নামেই জনপ্রিয়। তিনি বর্তমানে ধরিত্রী ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং বিভিন্ন দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছেন।
হোম ইকোনমিক্স কলেজের শিশুবর্ধন ও পারিবারিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীর প্রথম স্থান অর্জন করে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর ২০০৩ সালে যোগ দেন এডিডি ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি বিদেশী সংস্থায়। পাশাপাশি ভর্তি হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (এমডিএস) কোর্সে।
এডিডিতে কর্মরত থাকাকালীন (২০০৩-২০০৫) জাতীয় প্রতিবন্ধী কনভেনশন, প্রতিবন্ধী আইন ২০০১-এর পুনর্মূল্যায়ন, পিআর এসপিতে প্রতিবন্ধিতার অন্তর্ভুক্তিকরণ ঢাকা ও নরসিংদী জেলায় ২০টি প্রতিবন্ধী সংস্থা তৈরির মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখার পর তিনি অর্থনীতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবদান বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনের উদ্দেশ্যে দেখা করেন তৎকালীন অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সঙ্গে। ঠিক এই সময়ই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমডিএস কোর্সের শেষ বিষয়টি পড়ানো হচ্ছিলো সেটি ছিল ‘ঘএঙ’ং ধহফ ঝড়পরধষ ঊহঃবৎঢ়ৎবহরড়ঁৎং-এই কোর্সটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আদন ইসলাম সিদ্ধান্ত নেন নিজে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করবেন এবং তাঁর এই অভিপ্রায় ড. কাজী খলীকুজ্জমানের সামনে ব্যক্ত করেন। তিনি আগ্রহী হন এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে নিকেতনের একটি ভবনে বিনা মূল্যে একটি রুম বরাদ্দ করেন সংস্থার কার্যক্রম শুরু করবার জন্য। ২০০৬-এর জানুয়ারি মাসে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ধরিত্রী ফাউন্ডেশনের।
এ পর্যন্ত ধরিত্রী ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় গাবতলী সিটি কলোনিতে ৫টি নন-ফরমাল স্কুলে ৪৩৫ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সন্তান শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে, পরিচ্ছন্নতা কর্মী নারীগণ ১ মাসের স্ব-বেতন মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার অর্জন করেছেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন সকল পরিচ্ছন্নতা কর্মীর হেলথ কার্ড ইস্যু করেছে। সুপেয় পানি সরবারহের জন্য একটি রিজার্ভ ট্যাঙ্ক বসানো হয়েছে। ৫০০ পরিচ্ছন্নতা নারী কর্মী চীনা মাটির গহনা বানানোর প্রশিক্ষণ পেয়েছে, অনেকেই বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে।
আদন ইসলামের ‘স্বপ্ন’-একটি সম্পৃক্ত সমাজ যেখানে সকল মানুষ তার পছন্দ অনুসারে যে কোন ধরনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, ‘এই স্কুলগুলো আমাদের পরিচালনা করার কথা নয়, এই শিশুদের অধিকার রয়েছে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গুণগত শিক্ষা অর্জনের। যেহেতু ওদের পাশে কেউ বসতে চায় না, ওদের খেলতে নেয় না, পরিচয় গোপন করে স্কুলে ভর্তি হতে হয়, পরিচয় প্রকাশিত হয়ে গেলেই শুরু হয় বৈষম্য। সেহেতু আমাদের বাধ্য হয়ে পৃথক স্কুল পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। ২০০৭ সালে ধরিত্রী পরিচালিত একটি জরিপে পাওয়া গেছে অন্য শিশুরা দলিত শিশুদের গায়ে ‘থুতু ছিটিয়েছে’ কতখানি ঘৃণা আমরা আমাদের শিশুদের মনে গ্রোথিত করেছি এগুলোই তার প্রমাণ।’ তিনি আরও বলেন, এই বৈষম্য একদিনে তৈরি হয়নি; শতবর্ষ ধরে চলে আসছে। ১৮৪৭ সালে কনজারভেন্সি অফিসার জন ভাল খাবার, উন্নতমানের বাসস্থান সর্বোপরি উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে এদের ধরে নিয়ে এসেছেন, ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে আজ আমরা কথা রাখতে পারিনি।
উল্লেখ্য, আদন ইসলাম তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ধরিত্রী ফাউন্ডেশন’-এ ২০০৬ থেকে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন বিধায় অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমডিএস ডিগ্রী অর্জনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে এমফিল ডিগ্রী অর্জন করেছেন। পিকেএসএফ এবং ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্স থেকে অ মৎধফবফ ঃৎধরহবৎ-এর সার্টিফিকেট অর্জন করেছেন। তিনি বিভিন্ন ট্রেনিং সেশন পরিচালনা করে অর্থোপার্জন করে থাকেন, ট্রেনিং মডিউল ডেভেলপ করেন এবং বিভিন্ন গবেষণায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঈষরসধঃব ঈযধহমব অফধঢ়ঃধঃরড়হ-এর একটি ট্রেনিং মডিউল যা জলবায়ু দুর্গত ২০টি জেলায়।
ট্রেনিং প্রদানের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে তিনি ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান) এর ঈষরসধঃব গরমৎধঃরড়হ-বিষয়ক একটি গবেষণার কাজে যুক্ত আছেন।
সাংসারিক জীবনে তিনি দুটি পুত্রসন্তানের জননী। তার স্বামী ডা. আসিফ ইকবাল জোয়ার্দার, একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। এদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ১৮ বছর বয়সে বিয়ের পরে সংসার, সন্তান, পড়াশোনা সেই সঙ্গে উন্নয়নে অবদান রাখার পথটি অবশ্যই সহজ ছিল না। তাঁর ভাষায়, ‘আর দশটি মেয়ের মতো আমাকেও বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়েই এতদূর আসতে হয়েছে কিন্তু আমি মনে করি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, ব্যবস্থাপনামূলক দক্ষতা এবং সর্বোপরি লক্ষ্যে স্থির থাকার দৃঢ় অভিপ্রায় একজন মানুষকে শত বাধা পেরিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সম্মুখ পানে।
এদেশের নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে আমি বলতে চাই নিজেকে শ্রদ্ধা করুন। কখনও হাল ছেড়ে দেবেন না, যে কাজটি হাতে নিয়েছেন সেটির শেষ দেখে ছাড়ুন, ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুণ, আবার শুরু করুন। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভেবে পিছিয়ে যাবেন না। সফলতার পিছে না ছুটে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে থাকুন, সাফল্যে আপনার হাতের মুঠোয় অচিরেই ধরা দেবে।’
অপরাজিতা ডেস্ক
http://dailyjanakantha.com/index.php?p=details&csl=103954

0 comments:

Post a Comment