Tuesday, March 24, 2015

ঘরে আছি, আছি বাইরেও -জান্নাতুল ফেরদৌস (প্রথম আলো)

ঘরে আছি, আছি বাইরেও


জান্নাতুল ফেরদৌস | তারিখ: ০৯-০৬-২০১০
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থীরা মগ্ন ব্যবহারিক ক্লাসে
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থীরা মগ্ন ব্যবহারিক ক্লাসে
করিডরের এক প্রান্তে নওশীন ও তাঁর গ্রুপের সদস্যরা কাগজ, আঠা, রং দিয়ে নিবিষ্ট মনে কিছু একটা তৈরি করতে ব্যস্ত। রোদ এসে পড়ছে তাঁদের চোখ-মুখে। কিন্তু সেদিকে তাঁদের নেই কোনো ভ্রূক্ষেপ। একটু পরে গিয়ে দেখা গেল তাঁরা কাগজ আর কাঠের বোতাম দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন সুদৃশ্য কয়েন বক্স। এর পাশের রুমেই চলছে মাটির ল্যাম্প এবং পাটের আঁশ দিয়ে ঘরের পর্দা তৈরির কাজ। মাটিকে বেলে, স্কেলের সাহায্যে পিটিয়ে ছুরি, ব্লেড দিয়ে আকৃতি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন সব ল্যাম্প। আর পর্দা তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে পাটের আঁশের বেণি। রঙিন কাপড়ের ওপর আঠা, সুতা দিয়ে বসানো হচ্ছে নানা নকশার পাটের বেণি। চিত্র দুটি সরকারি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ব্যবহারিক শিল্পকলা বিভাগের শ্রেণীকক্ষের। এভাবেই এ কলেজের মেয়েদের সদা ব্যস্ত থাকতে হয় নানা সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল কাজে। আর এসব একাডেমিক জ্ঞান তাঁদের পেশাগত জীবন গড়তে সহায়তা করে। ‘অনেকেই মনে করেন, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে মেয়েদের শুধু রান্নাবান্না শেখানো হয়। আদতে এমনটি নয়। ঘর-গৃহস্থালিবিষয়ক জ্ঞানের পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, শিল্পকলা, তথা মননশীল নানা বিষয়ে এখান থেকে আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারছি।’ কথাগুলো বলছিলেন ব্যবহারিক শিল্পকলা বিভাগের এমএস শিক্ষার্থী শাহানা সুলতানা।
খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়ালেখা সম্পন্ন করে আইসিডিডিআরবিতে রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন দেবযানী সরকার। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকে মেডিকেলে পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেখানে সুযোগ না পেয়ে ভর্তি হই গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে। তবে মেডিকেলে পড়তে না পারার আফসোসটা এখন আর নেই।
অ্যাপোলো হাসপাতালের প্রধান ডায়েটিশিয়ান হিসেবে কর্মরত তামান্না চৌধুরী বলেন, ‘আমার মা পড়তেন গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে। তাই ছোটবেলা থেকেই ওখানে পড়ার ইচ্ছা ছিল। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে চান্স পাওয়ার পর যখন বিষয় নির্বাচনের ধাপটি এল, তখন ভাবলাম এমন একটি বিষয় নেব, যার জ্ঞান আমি ঘরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই প্রয়োগ করতে পারব। এই ভেবে খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। এখন আমি আমার পেশাগত জীবনে একাডেমিক জ্ঞানগুলো কাজে লাগাতে পরি, পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সঠিক, পরিমিত ও সুষম ডায়েট নিশ্চিত করতে সহায়তা করি। খুবই উপভোগ করি বিষয়টি। তবে শিক্ষার্থীদের স্নাতক শেষ করার পর ইন্টার্নশিপ করলে তাদের পেশাজীবন সম্পর্কে আগেই ধারণা হয়, যা তাদের চাকরির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।’ এমনটাই মনে করেন তামান্না চৌধুরী।

বিষয়ের খুঁটিনাটি
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ মেয়েদের জন্য একটি পেশাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ এবং সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের অধ্যক্ষ লায়লা আরজুমান্দ বানু জানান, এখানকার পাঠ্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য একজন শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি তাকে সমাজ ও পেশার জন্য প্রস্তুত করা। প্রতিটি বিষয়ের তত্ত্বীয়, ব্যবহারিক ও বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম করানো হয় শিক্ষার্থীদের। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহার করে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা হয় এখানকার শিক্ষার্থীদের।’

পঠন-পদ্ধতি
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় তিনটি স্তরে। উচ্চ মাধ্যমিক স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত পাঠ্যক্রম অনুযায়ী এখানে পাঁচটি বিষয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক কার্যক্রম এবং এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর কার্যক্রম চালু আছে। বিষয়গুলো হচ্ছে—১) খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান, ২) বস্ত্র, পরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প বিভাগ, ৩) শিশুবর্ধন ও সামাজিক সম্পর্ক, ৪) গৃহব্যবস্থাপনা ও গৃহায়ণ, ৫) ব্যবহারিক শিল্পকলা।
এ কলেজে স্নাতক পর্যায়ের জন্য ৩২০০ ক্রেডিট এবং স্নাতকোত্তর কার্যক্রমের জন্য ৬০০ ক্রেডিট পড়ানো হয়।
সর্বমোট ৩২ ইউনিটের পাঠ্যক্রমে মেজর ও মাইনর উভয় কোর্স আছে। প্রতি ইউনিট কোর্সের মান ১০০ এবং অর্ধ ইউনিট কোর্সের মান ৫০। মাইনর কোর্সগুলো প্রতিটি বিভাগের জন্য আবশ্যক।

পড়ার যোগ্যতা
স্নাতক পর্যায়ে পড়ার জন্য বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য এসএসসি ও এইচএসসি দুটোর জিপিএ কমপক্ষে ৬.৫০ হতে হবে। মানবিক শাখার জন্য এসএসসি ও এইচএসসি দুটোর জিপিএ লাগবে কমপক্ষে ৬.০০। কোনো পরীক্ষায় জিপিএ ৩.০০-এর কম হলে আবেদন করা যাবে না। আর যারা গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে, তাদের জন্য দুটো মিলে জিপিএ ৬.০০।

কর্মক্ষেত্রে সুযোগ
বস্ত্র, পরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সানজিদা হক জানান, এখানকার পড়ালেখার সব বিষয়ই কর্মমুখী। এখানে একজন শিক্ষার্থীকে এমনভাবে তৈরি করা দেওয়া হয়, যাতে সে নিজেই অনুপ্রাণিত হয় কিছু করতে।
বিসিএস পরীক্ষায় গার্হস্থ্য অর্থনীতি কাজের মাধ্যমে প্রভাষক হিসেবে কাজের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের এনজিওগুলোতে মা ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক প্রকল্প, পুষ্টিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালে পথ্যবিদ, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উপদেষ্টা, ক্যাটারিং ম্যানেজমেন্ট, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, ফ্যাশন ডিজাইনার, করপোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যাংকসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নিজ উদ্যোগে অনেকে উদ্যোক্তা হতে পারেন।

অন্যত্র পড়ার সুযোগ
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ছাড়াও এ বিষয়ে অন্যত্র পড়ার সুযোগ রয়েছে আরও কিছু জায়গায়। ন্যাশনাল কলেজ অব হোম ইকোনমিকস এবং বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ এর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু বিষয়ে একটি বিভাগ রয়েছে, যেখান থেকে ডিপ্লোমা ও পিএইচডি দেওয়া হয়।

http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2010-06-09/news/69524

0 comments:

Post a Comment